সৌদি খেজুর চাষ করে ময়মনসিংহের মোতালেবের বছরে আয় ৩০ লক্ষ টাকা
ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানার পাড়াগাঁও গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে আবদুল মোতালেব। দেশে সৌদি আরবের খেজুরের বাগান করে উপজেলার আর্থ-সামাজিক চিত্র আমূলভাবে পরিবর্তন করেছেন তিনি। নিজের খামার থেকে উদ্ভাবিত এই খেজুরবাগান থেকে তিনি এখন বার্ষিক গড়ে ৩০ লক্ষ টাকা আয় করছেন। খেজুর চাষের মাধ্যমে তাঁর খ্যাতি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, এমনকি স্থানীয় লোকজনের কাছে তি;নি পরিচিত ‘খেজুর মোতালেব’ নামে।
বাগানে বর্তমানে ৬ প্রজাতির খেজুর চাষ করা হচ্ছে। শুধু ফলের জন্য নয়, রস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে উদ্ভাবন করেছেন নতুন একটি প্রজাতিও। এটি স্থানীয় কৃষি উদ্যোগে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
খেজুরবাগানটি অবস্থিত ভালুকা সদর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে গতিয়ার বাজার সংলগ্ন।
বাগানের নামকরণ করা হয়েছে ‘মোফাজ্জল-মিজান সৌদি খেজুর বাগান’।
কথা বলে জানা যায়, মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া জানা আবদুল মোতালেব জীবন-জীবিকার টানে ১৯৯৮ সালে সৌদি আরবে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি কাজ করতেন আল কাছিম জেলার আল মাছনাব গ্রামের খালেদ আশরাফের খেজুরের বাগানে। কিন্তু সুবিধা করতে পারেননি।
ওই বাগানে কাজ করার সময়ই তাঁর মধ্যে দেশের মাটিতে খেজুর চাষের ইচ্ছা জাগে। তিন বছরের প্রবাসজীবন শেষে ২০০১ সালে তিনি দেশে ফেরেন এবং নিজের মনের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সৌদি আরব থেকে সঙ্গে নিয়ে আসেন ৩৫ কেজি খেজুরের বীজ। পরে বাড়ির আঙিনায় দুই বিঘা জমিতে সৌদি আরবের খেজুরের বাগান করার পরিকল্পনা করেন এবং বড় ছেলের নামানুসারে বাগানের নাম রাখেন ‘মোফাজ্জল সৌদি খেজুর বাগান’।
পরে দুই ছেলের নামানুসারে ‘মোফাজ্জল-মিজান সৌদি খেজুর বাগান’ নামকরণ করা হয়। ২৪ বছর আগে সৌদি আরব থেকে নিয়ে আসা ৩৫ কেজি বীজ থেকে ২৭৫টি চারা তৈরি করে খেজুরের বাগান শুরু করেন তিনি। তবে উৎপাদিত চারাগুলোর মধ্যে ১০টি চারা মরে যায়।
দীর্ঘ ১৮ বছরের চেষ্টায় ওই সব চারা থেকে মাত্র সাতটি মাতৃগাছ পান এবং পরবর্তী সময়ে ক্রমান্বয়ে পুরুষ গাছের সংখ্যা কমিয়ে মাতৃগাছগুলো থেকে কাটিং করে চারা উৎপাদন শুরু করেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, ভালুকার মাটি ও আবহাওয়ায় সৌদি আরবের মতো খেজুর ফলানো সম্ভব। বর্তমানে তাঁর সাত বিঘা জমির দুটি বাগানে তিন হাজারের বেশি সৌদি আরবের মূল্যবান আজোয়া, শুক্কারি, আম্বার, লিপজেল, মরিয়মসহ ছয় জাতের খেজুর চাষ করা হচ্ছে।
শুধু রসের জন্য তিনি সৌদি আরব ও দেশি জাতের খেজুরের রেণু ক্রস করে বিশেষ এক ধরনের খেজুরগাছের চারা উদ্ভাবন করেছেন এবং নিজের উদ্ভাবিত চারায় আরো সাত বিঘা জমিতে নতুন দুটি বাগান গড়ে তুলেছেন। ওই দুটি বাগানে তাঁর উদ্ভাবিত বিশেষ জাতের প্রায় আট হাজার পুরুষ খেজুরগাছ রয়েছে। নতুন জাতের ওই সব গাছ থেকে আগামী শীতে প্রথম রস নামানো হবে এবং রস থেকে তৈরি করা হবে সুস্বাদু গুড়। এ জন্য আগামী অগ্রহায়ণ মাস থেকে গাছগুলো চেঁছে হাঁড়ি বসানো হবে।
মোতালেবের বাগানে গিয়ে দেখা যায়, গাছে ঝুলে আছে আজোয়া, শুক্কারি, আম্বার, লিপজেল ও মরিয়ম জাতের খেজুরের কাঁদি। বাগানের নিয়মিত শ্রমিক কালু ও সুজন জানান, শুরু থেকেই তাঁরা ওই বাগানে কাজ করছেন। শুরুর দিকে কালুর প্রতি মাসের বেতন ছিল তিন হাজার টাকা। বর্তমানে বেতন বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার টাকা। আর সুজন শুরু করেছেন দেড় হাজার টাকা বেতনে। এখন পাচ্ছেন ১৮ হাজার টাকা।
মোতালেব জানান, তাঁর বাগানে উৎপাদিত খেজুরের স্বাদ ও গন্ধ হুবহু সৌদি আরবের খেজুরের মতো। মাঘ মাসে গাছে খেজুরের কাঁদি বের হতে শুরু করে। এরপর কাঁদিতে ফুল আসার পর প্রতিটি গাছে পরিমাণমতো কীটনাশক ও ভিটামিনজাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। সাত-আট মাস পর খেজুর বড় হয়ে গাছেই পাকতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে তা খাওয়ার উপযোগী হয়। বাগানের প্রতি কেজি মরিয়ম খেজুর ছয় হাজার, লিপজেল সাড়ে চার হাজার, আজোয়া খেজুর তিন হাজার, শুক্কারি এক হাজার এবং আম্বার আড়াই হাজার টাকা দরে বিক্রি করছেন। বাগানে কাটিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত প্রতিটি চারা ১৫ হাজার থেকে দুই লাখ টাকায় এবং বীজ থেকে উৎপাদিত প্রতিটি চারা পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। চারা ও খেজুর বিক্রিতে বছরে গড়ে তাঁর কমপক্ষে ৩০ লাখ টাকা আয় হয়। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো এলাকা থেকে মানুষ বাগান দেখতে বা চারা কিনতে আসে।
বাগান পরিদর্শনে আসা অতিথিদের তিনি ওই খেজুর দিয়ে আপ্যায়ন করেন। বর্তমানে বাগানে নিয়মিত পাঁচজন এবং সময়ে সময়ে দৈনিক মজুরিতে ১৪-১৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। ফরিদপুর, নাটোর, পাবনা, টাঙ্গাইলের ঘাটাইলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাঁর বাগানের চারার চাহিদা রয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২০০৪ সালের ১৬ জুলাই তাঁর খেজুরের বাগান পরিদর্শন করে গেছেন। তা ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানের অসংখ্য কৃষিবিদও তাঁর খেজুরবাগান পরিদর্শন করেছেন।
প্রক্রিয়াকরণ মেশিন হলেই সৌদি আরবের মতো খেজুর প্যাকেটজাত করতে পারবেন। তিনি জানান, দেশের মাটিতে সৌদি খেজুরের বাগান করার শুরুর দিকে খরচের জন্য তাঁকে পৈতৃক ছয় বিঘা জমি বিক্রি করতে হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বাগানের আয়ে তিনি আট বিঘা জমি কিনেছেন, তিন সন্তানকে করেছেন শিক্ষিত। এ ছাড়া তিন হাজার ২০০ বর্গফুটের দ্বিতল পাকা বাড়িও করেছেন মোতালেব। এ ছাড়া দেশি ও সৌদি খেজুরগাছ ক্রস করে একটি বিশেষ জাত উদ্ভাবন করেছেন, যা থেকে প্রচুর সুস্বাদু রস উৎপাদন করা সম্ভব। সূত্র-কালের কণ্ঠ