রেমিট্যান্স পাঠানোয় আমেরিকাকে ছাড়িয়ে শীর্ষে সৌদি আরব

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো পজিশনে আছে প্রবাসী আয়। মূলত সঙ্কটে পড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে যাচ্ছে প্রবাসী রেমিটেন্স। তবে এই প্রবাসী আয়ের উৎসে দেখা গিয়েছিল ব্যতিক্রম, তা এখন আবার আগের জায়গায় ফিরেছে।

গত দুই বছর সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসার ঘটনা দেখা যাচ্ছিল। তাদের পেছনে ফেলে সেই সৌদি আরব থেকে এখন আবার বেশি রেমিটেন্স আসছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার রেমিটেন্স প্রবাহের দেশভিত্তিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের শেষ মাস জুনে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছে সৌদি আরব থেকে। দেশটিতে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা ৪৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৬ কোটি ২০ লাখ ডলার এসেছে যুক্তরাজ্য থেকে।

মালয়েশিয়া থেকে এসেছে তৃতীয় সর্বোচ্চ; ৩৫ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে ৩২ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ২৩ কোটি ৮১ লাখ ডলার।

শুধু জুন মাস নয়, আগের দুই মাস মে ও এপ্রিল মাসেও সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছে সৌদি আরব থেকে। মে মাসে সৌদি আরব থেকে এসেছে ৫৩ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। আরব আমিরাত থেকে এসেছে ৩৫ কোটি ১৫ লাখ ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে ৩৪ কোটি ৬৮ লাখ ডলার।মালয়েশিয়া থেকে এসেছে ৩৪ কোটি ৪ লাখ ডলার।আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২ কোটি ৩৬ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছে।

এপ্রিল মাসে সৌদি আরব থেকে এসেছিল ৪৯ কোটি ১৪ লাখ ডলার। আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ৩৭ কোটি ২২ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ৩৩ কোটি ৭ লাখ ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে ২৯ কোটি ৪১ লাখ ডলার। আর মালয়েশিয়া থেকে এসেছিল ২১ কোটি লাখ ডলার।

অথচ গেল ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের আগের মাসগুলোতে (জুলাই থেকে মার্চ) সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে; ধারেকাছেও ছিল না সৌদি আরব।

যেমন- গত মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ৫৪ কোটি ৬১ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। সৌদি আরবের প্রবাসীরারা পাঠিয়েছিলেন ৪৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার।

শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, জুলাই থেকে মার্চ- এই নয় মাসে সৌদি আরবের চেয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেও বেশি রেমিটেন্স এসেছে দেশে। এমনকি কোনও কোনও মাসে যুক্তরাজ্য থেকেও সৌদির চেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছে।

২০২৩-২৪ অর্থ বছরে (১২ মাস, ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন) সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে, ৪৬০ কোটি (৪.৬০ বিলিয়ন) ডলার। সৌদি থেকে আসে তার প্রায় অর্ধেক ২৭৪ কোটি (২.৭৪ বিলিয়ন) ডলার। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিল সৌদির চেয়ে বেশি ২৯৬ কোটি (২.৯৬ বিলিয়ন) ডলার।

১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে দেড় কোটির বেশি মানুষ নানা কাজে ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সৌদি আরবে। মধ্যপ্রাচ্যের এই এক দেশেই ৫৫ লাখের মতো বাংলাদেশির কর্মসংস্থান। ফলে রেমিটেন্সও সেই দেশ থেকেই আসত বেশি।

দুই বছর আগে হঠাৎ করেই সৌদি আরব পেছনে পড়ে যায়। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে রেমিটেন্সে শীর্ষে উঠে আসে মধ্যপ্রাচ্যেরই আরেক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। আমিরাত থেকে ৪৬০ কোটি ডলার আসার বিপরীতে সৌদি প্রবাসীরা পাঠান ২৭৪ কোটি (২.৭৪ বিলিয়ন) ডলার।

ওই অর্থ বছরে যুক্তরাষ্ট্রেরও পেছনে পড়ে যায় সৌদি আরব। ওই দেশ থেকে রেমিটেন্স আসে ২৯৬ কোটি (২.৯৬ বিলিয়ন) ডলার।

২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জুলাই থেকে মার্চ সময়ে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। গত মার্চ মাসেও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী প্রবাসীরা যেখানে ৫৪ কোটি ৬১ লাখ ডলার দেশে পাঠান, তখন সৌদি প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ৪৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার।

শেষের তিন মাসের (এপ্রিল-জুন) চমকে গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে পেছনে ফেলেছে সৌদি আরব। এই আর্থিক বছরে আরব আমিরাত থেকে এসেছে ৪১৬ কোটি ৩৯ লাখ (৪.১৬ বিলিয়ন) ডলার। আর সৌদি আরব থেকে এসেছে ৪২৬ কোটি ৯০ লাখ (৪.২৬ বিলিয়ন) ডলার।

তবে নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) উল্লম্ফনের কারণে গত অর্থ বছরে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে; ৪৭৩ কোটি ৩০ লাখ (৪.৭৩ বিলিয়ন) ডলার।

এছাড়া ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে যুক্তরাজ্য থেকে ২৯৭ কোটি ৭৩ লাখ (২.৯৮ বিলিয়ন) ডলার ও মালয়েশিয়া থেকে ২৬৫ কোটি ৬৯ লাখ (২.৬৫ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে।

হঠাৎ করেই পিছিয়ে পড়া, তারপর আবার আগের স্থানে সৌদি আরবের ফিরে আসা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী অবস্থান করেন, সেখান থেকে বেশি রেমিটেন্স আসবে- এটাই তো স্বাভাবিক। বছরের পর বছর তাই তো হয়ে আসছে। মাঝে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে সৌদি আরব পেছনে পড়ে গিয়েছিল। এখন সেটা ঠিক করা হয়েছে। তাই সৌদি থেকে বেশি রেমিটেন্স আসছে।”

বিষয়টির ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “এখন থেকে ব্যাংকগুলোকে যে দেশের রেমিটেন্স, সেই দেশের আয় হিসাবে দেখানোর নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যে কারণে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি একটি নির্দেশনা দেয়, যাতে প্রতিটি ব্যাংককে প্রকৃত উৎস দেশ অনুযায়ী রেমিটেন্স হিসাব করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

এই নির্দেশনার কারণে সৌদি আরবের রেমিটেন্স এখন সৌদি আরবের খাতায়ই উঠছে; মাঝে যার ব্যত্যয় ঘটেছিল।

প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে সরাসরি ব্যাংক কিংবা এক্সচেঞ্জ হাউস- এই দুই মাধ্যমে দেশে আসে। এক্সচেঞ্জ হাউসের সংগ্রহ করা রেমিটেন্স ব্যাংকগুলো কিনে নিয়ে সুবিধাভোগীকে টাকা পরিশোধ করে। দেশের মোট রেমিটেন্সের বেশি অংশ আসে এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে।

যেসব দেশের এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে বাংলাদেশে রেমিটেন্স আসে এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিবন্ধিত কোম্পানি বেশি। ফলে প্রবাসীরা কোন দেশ থেকে অর্থ পাঠাচ্ছেন, তা না দেখিয়ে এক্সচেঞ্জ হাউসের নিবন্ধিত দেশ থেকে দেখানো হচ্ছিল। যে কারণে সৌদি আরব থেকে পাঠানো অর্থও যুক্তরাষ্ট্র ও আমিরাতের নামে আসত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা উদাহরণ দিয়ে বলেন, বাংলাদেশি কোনও ব্যাংক হয়ত যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ১০ লাখ ডলার কিনেছে। সেখানে পাঁচ দেশের রেমিটেন্স আছে। এটা দেশভিত্তিক আলাদাভাবে না দেখিয়ে পুরোটাই হয়ত যুক্তরাষ্ট্রের রেমিটেন্স হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিপোর্ট দিয়ে আসছিল ওই ব্যাংক।

“এতে প্রকৃত চিত্র প্রতিফলিত হত না। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কথাও উঠেছে। এখন থেকে ব্যাংকগুলোকে দেশভিত্তিক প্রকৃত চিত্রের আলোকে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। সব ব্যাংক যথানিয়মে রিপোর্ট করলে আর ভুল রিপোর্টিং হবে না,” বলেন তিনি।

১৯৭৪-৭৫ অর্থ বছর থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স আসা শুরু হয় বাংলাদেশে। ওই বছরে মাত্র ১ কোটি ১৮ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সেই রেমিটেন্স দুই হাজার গুণের বেশি বেড়ে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) এসেছে ২৭ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার; যা গত অর্থ বছরের পুরো সময়ের (১২ মাস, জুলাই-জুন) চেয়েও ১৫ শতাংশ বেশি।

এই ৫০ বছরে একবার ছাড়া প্রতিবারই সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছে।সে কারণে ‘রেমিটেন্স মানেই সৌদি’ কথাটি প্রচলিতই হয়ে গিয়েছিল।

গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ঘটে ব্যতিক্রম; ওই অর্থ বছরে সৌদিকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে।

২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ব্যতিক্রমের পর গেল অর্থ বছরের শুরুতেও প্রবাসী আয়ে ছিল একই ধারা।

২০২৫ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে প্রবাসীরা যে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ (২.১৮ বিলিয়ন) পাঠিয়েছিলেন, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৭ কোটি ৩৪ লাখ ডলার আসে যুক্তরাজ্য থেকে। সৌদি আরব থেকে আসে ২৭ কোটি ডলার, আমিরাত থেকে ২৪ কোটি ৯৫ লাখ ডলার।

ফেব্রুয়ারিতেও যুক্তরাষ্ট্র ছিল শীর্ষে; তার পরে ছিল আমিরাত। সৌদি আরব ছিল তৃতীয় স্থানে।

সৌদি আরবের পিছিয়ে পড়া নিয়ে তখন ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেছিলেন, এখন প্রবাসী আয় প্রেরণকারী মানিগ্রাম, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মতো বৈশ্বিক বড় বড় প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশ থেকে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রবাসী আয় কিনে নেয়। পরে সেগুলো একত্র করে নির্দিষ্ট একটি দেশ থেকে তা গন্তব্য দেশে পাঠায়। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণেই রেমিটেন্সের উৎস দেশের নাম বদলে যাচ্ছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংক নির্বাহী সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেছিলেন, “যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় বেড়ে যাওয়া মানে দেশটি থেকে প্রকৃত প্রবাসী আয় বেড়েছে, হয়ত তেমন নয়। অন্যান্য দেশের আয়ও প্রবাসী আয় প্রেরণকারী বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর হাত ঘুরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসছে। এ কারণে পরিসংখ্যানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় বড় প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে কাগজে-কলমে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকর নির্দেশনার পর এপ্রিলে এসে সৌদি আরব শীর্ষে ফেরে। এরপর মে ও জুন মাসেও শীর্ষে থাকল দেশটি।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শীর্ষ শ্রমবাজার সৌদি আরব। ১৯৭৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া শ্রমশক্তির ৩৬ শতাংশই গেছে দেশটিতে। সংখ্যার দিক থেকে যা ৫৫ লাখের বেশি।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১০ লাখের মতো প্রবাসী কাজ করছেন। আর আর যুক্তরাষ্ট্রে ৭ লাখের মতো প্রবাসী অবস্থান করছেন। সূত্রঃ সকাল সন্ধ্যা