মাত্র ৮ বছর আগে তিনি কখনো গাড়ি ধোয়ামোছার কাজ, কখনো বাসের হেলপার (সহযোগী) হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু বর্তমানে দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা বাণিজ্য না থাকলেও তিনি গড়ে তুলেছেন বহুতল ভবন, ডুপ্লেক্স বাড়ির পাশাপাশি দামি মোটরবাইক-কার কিনেছেন। টাকার জোরে রোহিঙ্গাসহ বিয়েও করেছেন ৩টি। ইয়াবা ও অ;স্ত্র কারবার করেই কয়েক কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন কক্সবাজার শহরের প্রবেশপথ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল সংলগ্ন পূর্ব লারপাড়া এলাকার মিজানুর রহমান। এমনটাই দাবি করেছেন এলাকাবাসীসহ প্রশাসনের একাধিক সূত্র।

র‍্যাব, পুলিশ, ইউনিয়ন পরিষদ ও এলাকাবাসী থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, মিজান সদরের ঝিলংজার ১ নং ওয়ার্ডের পূর্ব লারপাড়ার দিনমজুর ইয়ার মোহাম্মদ ও রোকেয়া বেগম দম্পত্তির ছেলে। তাঁর বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর থানায় একাধিক ইয়াবা মামলা এবং একটি অ;স্ত্র আইনে মামলা রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছোট বেলা থেকে বাস টার্মিনালে গাড়ি ধোয়ামোছার কাজ করতেন মিজান। বাবা ইয়ার মোহাম্মদ ছিলেন দিনমজুর। তিনি শহরের বড় বাজারে পণ্য উঠানামার কাজ করতেন। আর্থিক অনটনে পড়া লেখায় কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাটিতে পা রাখা হয়নি মিজানের। জীবন যুদ্ধে নেমে কাজ নেন গাড়ি ধোয়ামোছার। কয়েক বছর যেতে না যেতেই হয়ে উঠেন গাড়ির হেলপার। ২০১৬ সাল পর্যন্ত মিজান ও তার বাবা ইয়ার মোহাম্মদ এভাবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কখনো কখনো বাবা-ছেলে টমটম চালিয়ে সংসারের হাল ধরতেন।

২০২০ সালের দিকে লারপাড়া সড়কের মাথায় আল্লাহ দান টেলিকম নামের ছোট একটি ইলেক্ট্রিক ও বিকাশের দোকান দেন মিজান। দোকানটি ২০২২ সাল পর্যন্ত চালু থাকলেও এরপর থেকে বন্ধ রয়েছে। দোকান দেওয়ার আগে থেকেই সক্রিয় হয়ে উঠেন মা’দ’ক ও অ;স্ত্র কারবারে। দুটি অ;স্ত্রসহ মিজান র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন কারাভোগও করেছেন। কিছুদিন তিনি অ;স্ত্র-ইয়াবা ব্যবসায় নিষ্ক্রিয় থাকলেও চলতি বছরে এসে বাস টার্মিনালের শীর্ষ মা’দ’ক কারবারি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন মিজান। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর দৃশ্যমান কোন ব্যবসা বাণিজ্য না থাকলেও গড়ে তুলেছেন কোটি টাকার পাহাড়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৬ সাল পর্যন্ত গাড়ির হেলপারি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসলেও ১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে তার ঘনিষ্ঠ রোহিঙ্গা বান্ধবী নিয়ে গড়ে তুলেন এক মা’দ’ক পাচারকারী সিন্ডিকেট। এরপর থেকে তাকে পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। একসময় তার মা’দ’ক পাচারকারী সিন্ডিকেটের প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করতেন টেকনাফের পুরাতন রোহিঙ্গা নারী নুর হাফিজা। মা’দ’ক সিন্ডিকেট থেকে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। বর্তমানে নুর হাফিজাকে বিয়ে করে দিয়েছেন স্ত্রীর মাধ্যমে। কাগজে-কলমে নুর হাফিজা মিজানের স্ত্রী হিসেবে থাকলেও তিনিই মূলত মা’দ’ক পাচারকারী সিন্ডিকেট প্রধানের ভূমিকায় রয়েছেন।

নুর হাফিজাকে বিয়ের পর থেকে নতুন সেটআপে রাজার হালতে শুরু করে মিজানের মা’দ;ক সাম্রাজ্য। সেই থেকে আজ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছেন ইয়াবা পাচার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে থেকে যান ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ রয়েছে, সদর, রামু থানা পুলিশসহ মা;দকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জব্দকৃত মা;দক ক্রয় করেন মিজান। বাস টার্মিনাল এলাকায় থানা পুলিশের একাধিক অফিসারদের সাথে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিতে দেখা যায় মিজানকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক সময়ের রিক্তহস্ত মিজান বাস টার্মিনাল এলাকায় বিডিআর ক্যাম্পের সেলিম গংদের কাছ থেকে ১ কোটি ৫ লাখ টাকায় ক্রয় করেছেন সাড়ে ৩ গন্ডা জমি। সেটি বর্তমানে শ্যামলী কাউন্টার হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন। পাশের জমিতে বর্তমানে চলছে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ। পূর্ব লারপাড়া এলাকায় দুই স্ত্রীর জন্য নির্মাণ করেছেন দুটি আলাদা ভবন। বর্তমানে তারা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করছেন। বাবার বসত ভিটায় নির্মাণ করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। এছাড়াও মিজানের রয়েছে ১ টি কার, একাধিক সিএনজি ও দামি বাইক রয়েছে। এই গাড়িগুলো মূলত মা;দক পাচারের কাজে ব্যবহৃত হয় বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের আগে একাধিকবার ইয়াবাসহ থানা পুলিশের হাতে আটক হন মিজান। মা;দকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে আইনের মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মিজান। এছাড়া তিনি ২০২২ সালের শুরুতে পূর্ব লারপাড়া তাঁর বাড়ি থেকে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র সহ আটক হন। এই মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি তিনি। তাছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মা;দকের মামলা রয়েছে।

এবিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জনপ্রতিনিধি বলেন, এক সময় মিজান ও তাঁর পরিবার দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করতেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁদের পরিবারের আর্থিক অবস্থান বদলে গেছে। তাদের পরিবার ইয়াবা ও অ;স্ত্র কারবার করেই টাকার পাহাড় গড়েছেন। এদের বিরুদ্ধে ইয়াবা মামলাও রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, মিজান কিংবা তাঁর পরিবারের দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা বাণিজ্য নেই। তবে বর্তমানে তাদের রয়েছে বহুতল ভবন, গাড়ির কাউন্টার ও গাড়িসহ সহ আরো অনেক সম্পদ।

স্থানীয়রা বলেন, ইয়াবা অ;স্ত্রসহ র‍্যাব-পুলিশের হাতে আটক হওয়া মিজান একটি ইয়াবা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর গ্রুপে স্ত্রী রোহিঙ্গা হাফিজাসহ আরো অনেকে রয়েছে। পুলিশের হাতে আটকের পর থেকে কথিত দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যদের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠে। তাদের জব্দকৃত মা;দকের ক্রেতা হিসেবে মিজান বর্তমানে কাজ করছেন। তার স্ত্রী নুর হাফিজার মাধ্যমে সেই মা;দক সারা দেশে পাচার করছেন মিজান।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, মিজানের অবৈধ সম্পদ ও মা;দক সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। এখন তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তবে অভিযুক্ত মিজান বলেন, আমি ও আমার পরিবার একসময় দরিদ্র ছিল একথা সত্য। ১ কোটি ৫ লাখ টাকা দিয়ে জমিটি আমার নামে ক্রয় করলেও সেই টাকা বিদেশ থেকে আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন পাঠিয়েছেন। কি এমন কারণে শ্বশুর বাড়ির লোকজন আপনার নামে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা দিয়ে জমি কিনেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোন সদোত্তর দিতে পারেনি।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত র‍্যাব দুটি অ;স্ত্র দিয়ে তাঁকে চালান দিয়েছে দাবি করে তিনি আরো বলেন, তাঁর কাছে বিদেশ থেকে টাকা আসার ডকুমেন্টপত্র রয়েছে। তবে অনেকদিন সময় দেওয়া হলেও তিনি সেই কাগজ দেখাতে পারেননি।

বাস টার্মিনালের একাধিক শ্রমিক নেতা ও লারপাড়ার সমাজ নেতারা বলেন, মিজানের পারিবারিক অবস্থা একসময় খুবই খারাপ ছিল। তবে এটা অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। তাদেরকে এখন উচ্চবিত্ত পরিবার বলা চলে।

তারা আরও বলেন, মিজানের মা;দক মামলা ও অ;স্ত্র আইনে মামলা রয়েছে বলে শুনেছি। তাছাড়া তাঁর স্ত্রী নুর হাফিজা একজন রোহিঙ্গা এবং মা;দক সম্রাজ্ঞী। তবে কারবারিদের সামাজিক ও রাজনৈতিক বয়কট করা দরকার।