সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিজিট ভিসায় যেভাবে প্রতারণার ফাঁদ
কাজের খোঁজে মরুর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে পা রেখে অসংখ্য নারীকর্মীর স্বপ্ন ভাঙছে। বিশেষ করে কাজের নিশ্চয়তা ছাড়াই শুধু ভিজিট ভিসা নিয়ে দেশটিতে আসা নারীরা হচ্ছেন প্রতারিত।
অভিযোগ আছে, ভিজিট ভিসায় দেশটিতে এনে উপযুক্ত কাজ না দিয়ে স্পা সেন্টার, বার ও নাইটক্লাবের কাজে নারীদের যুক্ত করে দালালরা। ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী এসব নারীকে বিভিন্ন অনৈতিক কাজে বাধ্য করাসহ বিক্রি করে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে অহরহ। শেষমেশ ভুক্তভোগীরা নিজেকে রক্ষায় কেউ পালিয়ে বাঁচেন, কেউ অন্য প্রবাসীর আশ্রয় নিয়ে দেশে ফেরার পথ খোঁজেন। তবে ভুক্তভোগী অধিকাংশেরই পাসপোর্ট আটকে রাখে দালালরা। এতে নারীকর্মীরা দেশে ফেরার একমাত্র উপায় হিসেবে বেছে নেন লস্ট পাসপোর্টের আবেদন। ভুক্তভোগী এমন নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দেশটিতে থাকা দুটি বাংলাদেশ মিশনের তথ্যেও মিলেছে এর সত্যতা।
আবুধাবি বাংলাদেশ দূতাবাস ও দুবাইয়ের বাংলাদেশ কনস্যুলেটের তথ্য বলছে, গত সাত মাসে লস্ট পাসপোর্টের আবেদন পরবর্তী সহযোগিতা নিয়ে দেশে ফিরেছেন অনেক নারী। গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দুবাই ও উত্তর আমিরাতে ২৯ নারীকর্মী লস্ট পাসপোর্টের আবেদন করেন। আবুধাবিতে লস্ট পাসপোর্টের আবেদন করেন ২৩ নারীকর্মী। এদের মধ্যে অধিকাংশই প্রতারিত। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় উদ্ধার শেষে এরই মধ্যে ৩৮ জনকে দেশে পাঠানো হয়েছে।
তেমনই প্রতারিত একজন নওগাঁর মেয়ে রিনা সুলতানা। কাজের খোঁজে আমিরাতে গিয়েই টের পান দালালের পাতা ফাঁদে পা আটকে গেছে তাঁর। মাসখানেক পর নিজেকে বাঁচাতে আবুধাবি মোসাফ্ফা নগরীতে একটি পরিবারের কাছে আশ্রয় নেন। দালালের হাতে নিজের পাসপোর্ট আটকে থাকলেও আবুধাবির বাংলাদেশ দূতাবাসে লস্ট পাসপোর্টের আবেদন করেন রিনা। পাসপোর্ট এলেই শুরু হবে দেশে ফেরার প্রক্রিয়া। তবে ওই আবেদনেও প্রায় মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। এখন উৎকণ্ঠা নিয়ে দেশে ফেরার প্রতীক্ষায় আছেন এ নারীকর্মী।
চুয়াডাঙ্গার মেয়ে রেবেকা খাতুনের আমিরাতের ভিসা ইস্যু হয় গেল মার্চে। মাস তিনেক পেরোতেই বাধ্য হয়ে তাঁকে ফিরতে হয়েছে দেশে। ভিসায় উল্লেখ ছিল একটি প্রতিষ্ঠানের সেলস এক্সিকিউটিভ পদে কাজ করবেন তিনি। তবে দেশটিতে যাওয়ার পর বিক্রি করে দেওয়া হয় একটি স্পা সেন্টারে। দিনরাত শারীরিক নির্যাতনের শিকার এ নারী সেখান থেকে বাধ্য হয়ে পালিয়ে যান। পরে অন্য প্রবাসীর সহায়তায় দুবাইয়ের বাংলাদেশ কনস্যুলেটের আশ্রয় প্রার্থনা করেন। তবে কনস্যুলেটে নারীকর্মীদের জন্য সেফহোম ব্যবস্থা না থাকায় দ্রুত সময়ে তাঁকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা নেয় মিশন।
এদিকে, দীর্ঘদিন ধরে আমিরাতে বাংলাদেশি পুরুষকর্মীর ভিসা জটিলতা থাকলেও নারীকর্মীর জন্য তা ছিল সহজলভ্য। যে কোনো ক্ষেত্রে নারীকর্মী সহজে কাজের ভিসা ও ভিজিট ভিসা পেয়েছেন। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০০৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে দেশটিতে নারীকর্মী গেছেন ১ লাখ ৩১ হাজার ২৭০ জন।
শুধু এ বছরের প্রথম ছয় মাসে আমিরাতে গেছেন ৭৭৩ নারীকর্মী।
দুবাইয়ের দেরার একটি আমের সেন্টারের নির্বাহী ব্যবস্থাপক কামাল হোসেন খান সুমন জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে সম্প্রতি দেশটিতে প্রবাসীরা বিক্ষোভ করায় বাংলাদেশিদের সব ধরনের ভিসার আবেদনে ‘রেড সিগন্যাল’ দেখানো হচ্ছে। এর আগেও নারীরা গৃহকর্মীসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভিসা পেয়েছেন।
হয়রানি ও প্রতারণা এড়াতে নারীকর্মীদের বিদেশ যাওয়ার আগে আরও সতর্কতার কথা বলছেন দেশটিতে থাকা মিশন কর্মকর্তারা। বিশেষ করে বিদেশ যাওয়ার আগে নিয়োগকর্তা এজেন্সির তথ্য সঠিকভাবে জানা, লোভনীয় ও আকর্ষণীয় কাজের প্রস্তাব গ্রহণের আগে সতর্কতা, কর্মস্থলে যাওয়ার আগে ভিসার মেয়াদ ও সত্যতা যাচাই এবং কোন ভিসায় যাচ্ছেন তা নিশ্চিত হওয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। এ ছাড়া চুক্তিপত্রে লেখা ভাষা বুঝে সই করতেও পরামর্শ দিচ্ছেন মিশনে থাকা লেবার কাউন্সিলররা।
আবুধাবি বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর হাজরা সাব্বির হোসেন সমকালকে বলেন, ‘ভিজিট ভিসার বাস্তব অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রচারণা দরকার। আমিরাতে শ্রমবাজারে নারীদের সুযোগ ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়ে গণমাধ্যমে সচেতনতাও বাড়াতে হবে। ভিসা পেলেই দালালের ওপর ভরসা করে চলে আসা ঠিক হবে না। আসার আগে কোন ভিসায় আসছেন, সেটা জানতে হবে।’