হঠাৎ করেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) বাংলাদেশীদের সম্পদ বাড়ছে। বাড়ছে বাংলাদেশী মালিকানাধীন নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যাও। সর্বশেষ ৬ মাসেই দেশটিতে বাংলাদেশী মালিকানাধীন ১ হাজার ৪৪টি কোম্পানি কেবল দুবাই চেম্বার অব কমার্সে সদস্যপদ নিয়েছে। এতে দুবাই চেম্বারের সদস্যপদ পাওয়া বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন কোম্পানির মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৯৭৫টিতে। দেশটির একটি রাজ্যে নিবন্ধিত কোম্পানির যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে, তাতে এই চিত্র দেখা গেছে। চলতি বছরের কেবল প্রথমার্ধেই (জানুয়ারি থেকে জুন) দুবাই চেম্বার অব কমার্সে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সদস্যপদ নেয়ার হার ৪৭ শতাংশ বেড়েছে।

দুবাই চেম্বার অব কমার্স চলতি মাসে নিজেদের ওয়েবসাইটে এই তথ্য প্রকাশ করে। এই চেম্বারের সাড়ে তিন লাখের বেশি সদস্য কোম্পানি চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১৩ হাজার ৭০০ কোটি দিরহাম বা ৩ হাজার ৭২৯ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি ও পুনরায় রপ্তানি করেছে বলে ওয়েবসাইটে তথ্য দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে অবশ্য বৈধভাবে বিনিয়োগের অনুমতি নিয়ে কেউ ইউএইতে ব্যবসা করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, এখন পর্যন্ত ১৭ প্রতিষ্ঠান সরকারের অনুমোদন নিয়ে বিদেশে অফিস কিংবা ছোট আকারের কারখানা গড়ে তুলছে।

বৈধ অনুমতি না থাকলেও ইউএই’র দুবাই, শারজাহ, আবুধাবি, আজমানসহ বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশিরা নিজের ও অন্যের নামে ভিলা, ফ্ল্যাট, ছোট হোটেল, তারকা হোটেলসহ নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছেন। তবে এসব বিনিয়োগে নিজেদের আড়াল করে রাখছেন অনেকেই। এ জন্য তারা বাংলাদেশের পরিবর্তে আলবেনিয়া, সাইপ্রাসসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব ব্যবহার করেন বলে জানা যায়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মোটাদাগে বলা যায়, পাচারকৃত অর্থ দিয়েই ইউএইতে বাংলাদেশিদের সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠছে। আর ১১ হাজার বাংলাদেশি মালিকানাধীন কোম্পানি দুবাই চেম্বারের সদস্য হওয়ার তথ্যই বলছে, দেশটিতে অর্থ পাচার বাড়ছে।

তবে শ্রমিক হিসেবে দেশটিতে গিয়ে বৈধভাবে আয় করে পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগ করেছে, এমন শ্রেণিও আছে।
সে কারণে দুবাই চেম্বার থেকে পুরো তালিকা নিয়ে যাচাই-বাছাই করা দরকার, কারা বৈধ বিনিয়োগ করেছেন আর কারা অবৈধ বিনিয়োগ করেছেন। সরকার আগ্রহী হলে সহজেই ইউএই সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এই তালিকা সংগ্রহ করতে পারবে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে থাকা একাধিক বাংলাদেশি জানান, ইউএইতে চাকরি ছাড়া অন্য যেকোনো ব্যবসা করতে গেলে লাইসেন্স নিতে হয়, আর সেই লাইসেন্সের সময়ই দেশটির চেম্বারের সদস্য হওয়ার ফি নেয়া হয়। সেখানে পরামর্শক, ট্রেডিং, ফ্ল্যাটের ব্যবসা, জমির ব্যবসাসহ দুই হাজারের বেশি ব্যবসার লাইসেন্স নেয়ার সুযোগ আছে। দেশ থেকে যাওয়া শিক্ষিতরা ছোট ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন, আর প্রভাবশালীরা অর্থ পাচার করে অন্য ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছেন। এ জন্য চেম্বারের সদস্যপদ পাওয়া বাংলাদেশিদের সংখ্যা এত বেশি।

দুবাই চেম্বার জানিয়েছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৩০ হাজার ১৪৬টি কোম্পানি তাদের সদস্যপদ নিয়েছে। তার মধ্যে ২২ শতাংশই ভারতীয়। সব মিলিয়ে ৯০ হাজার ১১৮টি ভারতীয় মালিকানাধীন কোম্পানি এই চেম্বারের সদস্যপদ নিয়েছে।

দুবাই চেম্বারের সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ আলী রাশেদ লোথ এক বিবৃতিতে বলেছেন, চেম্বারের নতুন সদস্যের তালিকায় বিভিন্ন দেশের জাতীয়তাই প্রমাণ করে দুবাইয়ে গতিশীল ব্যবসায়িক পরিবেশ বিদ্যমান রয়েছে।

আজমান রাজ্য এবং দুবাইয়ের পাম জুমেইরা, এমিরেটস হিল, সিলিকন ওয়েসিস, বিজনেস বে- এসব এলাকায় অনেক বাংলাদেশি নিজস্ব ভিলা গড়ে তুলেছেন। শত শত একর জমিও কিনেছেন কেউ কেউ।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি গত জানুয়ারিতে জানিয়েছে, তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে সম্পদ কিনেছেন ৪৫৯ জন বাংলাদেশি। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রোপার্টি ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে, কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। ইউএইতে জনসংখ্যার ১০ শতাংশের বেশি বাংলাদেশি, যাদের বড় অংশই শ্রমিক। তারা নিয়মিত বাংলাদেশে আয় পাঠান।

বাংলাদেশ থেকে বিভিন্নভাবে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয় বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে। অর্থ পাচার রোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যতম সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ)। অর্থ পাচার বন্ধে সরকারের খুব বেশি পদক্ষেপ দেখা যায় না।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কানাডায় বাড়ি ও মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশিদের ইউএইতে সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুসন্ধান করা উচিত, কারা দুবাই চেম্বারের সদস্য হয়েছেন। তারা হুন্ডি করে বা ব্যাংকঋণের টাকা সেখানে নিয়ে গেছেন কি না। বেআইনিভাবে অর্থ মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে নিয়ে গেলে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া দরকার। কারণ, তাদের কারণে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।