ডেনমার্কের গ্রিনল্যান্ড থেকে বহু বছরের পুরোনো বরফ কিনছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। দুবাইয়ের বিলাসবহুল বার ও রেস্তোরাঁগুলো এই বরফ কিনছে। তবে এই পানীয় হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক পোস্টের প্রতিবেদনেও একই তথ্য জানানো হয়েছে।

আর্কটিক আইস নামে একটি স্টার্টআপ কোম্পানি দুবাইয়ের অভিজাত বারগুলোতে এসব বরফ রপ্তানি করছে। মূলত সেখানকার বিভিন্ন পশ ও নামিদামি বারের পানীয় ঠান্ডা করতেই এসব বরফ ব্যবহার করা হবে। চলতি বছর গ্রিনল্যান্ড থেকে ২২ টন পরিমাণ বরফের প্রথম চালান সরবরাহ করেছে কোম্পানিটি। ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠিত আর্কটিক আইস ইতিমধ্যে আকর্ষণীয় অথচ বিতর্কিত ব্যবসায়িক মডেলে পরিণত হয়েছে।

কোম্পানিটি গ্রিনল্যান্ডের রাজধানী নুকের সমুদ্রের খাঁড়িতে ‘আইস শিট’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া হিমশৈল খোঁজে।

আর্কটিক আইসের সহপ্রতিষ্ঠাতা মালিক ভি. রাসমুসেন বলেন, ‘আমরা সবচেয়ে পরিষ্কার এবং সবচেয়ে প্রাচীন ও বিশুদ্ধ বরফ খুঁজি।’

পছন্দের হিমশৈল পাওয়ার পর ওটাকে থামিয়ে ক্রেন দিয়ে জাহাজে তুলে নেন তারা। তারপর ওটাকে কেটে ছোট ছোট টুকরো করে আলাদা আলাদা ক্রেটে রাখেন।

কোম্পানিটি প্রতিটি হিমশৈলের নমুনা ল্যাবে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয় যে ওতে কোনো জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া নেই। এরপর ওই বরফ গ্রিনল্যান্ড থেকে দুবাইয়ে রপ্তানি করা হয়। দুবাইয়ে পৌঁছানোর পর ওইসব বরফ ফের মোড়কজাত করে বিক্রি করা হয়।

আর্কটিক আইসের দাবি, একটি প্রাকৃতিক উৎসকে কাজে লাগানোর নতুন পথ দেখাচ্ছে তারা। এছাড়া নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরির পাশাপাশি আর্কটিক নিয়ে সচেতনতা বাড়াচ্ছে।

তবে সমালোচকদের মতে, দুবাই নিজেরাই নিজেদের বরফ বানিয়ে নেয়। কাজেই জীবাশ্ম জ্বালানিতে চলা জাহাজে অরে হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এ পণ্য রপ্তানি করা স্রেফ অপচয়।।

নিজেদের কোক, কফি বা ককটেলে মেশানো বরফ কোত্থেকে এল, তা নিয়ে সম্ভবত খুব কম মানুষই ভাবে। তবে এটি একটি বড় ব্যবসা।

আগে বরফের জোগান আসত হিমবাহের মতো প্রাকৃতিক উৎস থেক। কিন্তু বার ও রেস্তোরাঁর জন্য বিশাল পরিসরে বরফ তৈরির যন্ত্র আবিষ্কারের পর এ চর্চা বন্ধ হয়ে যায়। ২০২২ সালে আইস কিউব, ব্লক ও গুঁড়া বরফের বাজারের আকার ছিল ৫ বিলিয়ন ডলার।

গত কয়েক দশকে প্রাকৃতিক বরফের ব্যবসার সুদিন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে নানাভাবে। কিন্তু সাফল্য তেমন মেলেনি। ২০১৫ সালে নরওয়ের উত্তরাঞ্চল থেকে আনা বরফের কিউব বিক্রির চেষ্টা করেছিল একটি কোম্পানি, কিন্তু স্থানীয় বিরোধিতার কারণে ওই প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়।

তবে রাসমুসেন আশা করেন, সঠিক বাজারকে টার্গেট করতে পারলে তারা সাফল্য পাবেন।

তবে বরফের প্রাকৃতিক উৎস ক্রমেই কমে আসছে। এর মধ্যে এই বরফ রপ্তানির ব্যবসায় নামার জন্য আর্কটিক আইসকে নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে।

কোম্পানিটির ইনস্টাগ্রাম ভিডিওর কমেন্টে অনেকেই তাদের ব্যবসার সমালোচনা করেছেন। একজন লিখেছেন, ‘…আপনারা এ গ্রহ ধ্বংসে সাহায্য করছেন!’ আরেকজন লিখেছেন, ‘এ কোন ডিস্টোপিয়া?’

রাসমুসেন বলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন তারা।

‘আমরা জানতাম সমালোচনা হবে, কিন্তু এভাবে যে হত্যার হুমকি আর প্রতিনিয়ত হেনস্তা হতে হবে তা ধারণা করতে পারিনি,’ বলেন তিনি।

আর্কটিক আইস বলছে, ‘পরিবেশের ওপর ন্যূনতম প্রভাব পড়বে’, এমনভাবে কাজ করে তারা। এছাড়া ভবিষ্যতে জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত জাহাজ বাদ দিয়ে হাইব্রিড বা ব্যাটারিচালিত জাহাজ ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

তবে কিছু বিশেষজ্ঞ তাদের এসব প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হতে পারছেন না। উডওয়েল ক্লাইমেট রিসার্চ সেন্টারের সিনিয়র বিজ্ঞানী জেনিফার ফ্রান্সিস বলেন, ‘রেফ্রিজারেটেড জাহাজে করে দুবাইয়ে (বরফ) পরিবহন করতে প্রচুর জ্বালানি লাগবে।’

এছাড়া দাবানলের ধোঁয়া, ধুলো অথবা অগ্ন্যূৎপাতের ছাইয়ের মতো প্রাকৃতিক উৎসের মাধ্যমেও ওই বরফ দূষিত হতে পারে বলে জানান ফ্রান্সিস।

তিনি বলেন, ‘একে আমি খুব চটকদার বিজ্ঞাপন হিসেবেই দেখব—অর্থহীন চমক যা অতিধনীদের আকৃষ্ট করবে। বাজি ধরে বলতে পারি, হিমবাহের বরফ আর অন্য বরফের স্বাদে পার্থক্য ধরতে পারবে না কেউ।’

অন্যদিকে রাসমুসেন বলছেন, প্রাচীন বরফের স্বাদ না থাকার অর্থ হচ্ছে এটি পানীয়ের স্বাদ বদলাতে পারবে না। এছাড়া তারা মানুষকে এমন বরফের স্বাদ দিতে চান যা কখনও মানুষের হাতে দূষিত হয়নি।

অনেকেরই অবশ্য গ্রিনল্যান্ডের বরফের বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। একে শিল্প ও রুচির সঙ্গে তুলনা করছেন কিছু বিশেষজ্ঞ।