রাজধানীর বনশ্রীর বাসিন্দা খায়রুল ইসলাম। তাঁর বিরুদ্ধে অভিনব প্রতারণার মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী ১৭ বাংলাদেশির কাছ থেকে প্রায় ৩৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। টাকা ফেরত পেতে মামলা করে বিপাকে পড়েছে ভুক্তভোগীদের পরিবার। প্রতিনিয়ত ফোন করে তাঁদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে।

প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের অন্যতম নাজমুল হক। তিনি দীর্ঘদিন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বসবাস করছেন। বন্ধু জহুর আলীর মাধ্যমে গত বছর এপ্রিলে ঢাকায় খায়রুলের সঙ্গে পরিচয় হয় নাজমুলের। তাঁর ভাষ্যে, হঠাৎ একদিন দেশ থেকে জহুর আলী ফোন করে খায়রুলকে তাঁর কাছে কয়েক দিন আশ্রয় দিতে বলেন।

অনুরোধে নিজের মেসে রাখলেও অভিজ্ঞতার অভাব ও ভাষাগত কারণে চাকরির ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। পাঁচ মাসের বেশি মেসে থেকে খায়রুল সবাইকে ফাঁদে ফেলেন। ঢাকায় বাবার ভুয়া প্রভাব-প্রতিপত্তির গল্প ফেঁদে আকৃষ্ট করে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে দুবাই থেকে পালিয়ে যান।

অন্য ভুক্তভোগীরা জানান, খায়রুল তাঁদের জানান, রাজধানীর লালমাটিয়ায় নারীদের জন্য সরকার একটি ব্যবসায়ী প্রকল্প চালু করেছে, সেখানে তাঁর বাবা আব্দুল গাফফার ১০টি দোকান বরাদ্দ পেয়েছেন। এগুলো নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করা হবে। খায়রুলের এমন প্রস্তাবে প্রভাবিত হয়ে নাজমুল মা, স্ত্রী ও বোনের নামে তিনটি দোকানের জন্য ৯ লাখ টাকা দেন।

তাঁর দেখাদেখি দুবাইয়ের মেসমেট জামাল উদ্দিন ও জসিম মিয়া একটি করে এবং মিজানুর রহমান তিনটি দোকান নিতে মোট ১৫ লাখ টাকা দেন। বিপুল অঙ্কের টাকা হাতে পেয়ে খায়রুল দুবাইয়ে হুন্ডি কারবার ও পর্তুগালে লোক পাঠানোর ব্যবসা শুরু করেন। এই ব্যবসার জন্যও তিনি নাজমুলের অন্য চার বন্ধুর কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। খায়রুল দুবাইয়ে মোট ১৭ প্রবাসীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।

এর মধ্যে তিনি ২৪ লাখ ৫৯ হাজার ১২০ টাকা দুবাই থেকে দেশে ৯টি ব্যাংক হিসাব ও পাঁচটি মোবাইল ব্যাংকিং নম্বরে পাঠান। এসব হিসাবধারী হলেন– খায়রুলের স্ত্রী রোকেয়া আক্তার সুখী, ভাই অলিউর রহমান বাপ্পী, বাবা আব্দুল গাফফার, মা বেবি আক্তার ও পারিবারিক ‘মেহরিমা নারী উন্নয়ন সংস্থা’। এর মধ্যে এনজিওর ব্যাংক হিসাবে সবচেয়ে বেশি টাকা এসেছে। টাকা হস্তান্তরের পর খায়রুল দুবাই থেকে পালিয়ে ওমান হয়ে বাংলাদেশে ফেরেন। বর্তমানে তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন।

এদিকে, প্রতারণার শিকার হয়ে টাকা ফেরতের জন্য দেশে খায়রুলের পরিবারকে চাপ দিলে তারা ভুক্তভোগীর পরিবারকে মারধর ছাড়াও প্রাণনাশের হুমকি দেয়। এর মধ্যে বনশ্রীর বাসায় ভুক্তভোগী জামালের স্ত্রী ও খালাতো ভাই গেলে তাঁদের প্রাণনাশের হুমকি দেয় খায়রুলের পরিবার।

ভুক্তভোগীদের নামে জিডিও করেন খায়রুলের ভাই বাপ্পী। অন্যদিকে, আদালতে ভুক্তভোগী নাজমুলের বড় বোন আমেনা আক্তার খায়রুল, তাঁর মা-বাবা, ভাই, স্ত্রী ও এনজিওর নামে মামলা করেন।

নাজমুল হক সমকালকে বলেন, ‘খায়রুল পালিয়ে বাংলাদেশে যাওয়ার আগে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। মাঝে হঠাৎ বললেন, জরুরি বের হতে হবে। কদিন পরে টাকা নিয়ে ফিরবেন। আমাদের মেসের ১৭ বাংলাদেশির সঙ্গেই তিনি প্রতারণা করেছেন।’

আরেক ভুক্তভোগী জামান মিয়া বলেন, ‘দুবাই থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর গত বছর ১৮ অক্টোবর খায়রুলের পাসপোর্টের ঠিকানা– ঢাকা দক্ষিণ বনশ্রীর বাসায় আমার খালাতো ভাই রোমান আহমেদ ও স্ত্রী পপি গেলে তাঁর ভাই বাপ্পি সিঁড়িতেই আটকে দিয়ে বলেন, বাসায় মা অসুস্থ, এসব শুনলে তিনি মারা যাবেন। আপনারা কদিন অপেক্ষা করেন, টাকা দিয়ে দেব। এর পর থেকে নানা টালবাহানা করছেন।’

ইতোমধ্যে খায়রুলের বাবা গাফফার মামলার বাদী আমেনা বেগমকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। বাকিদেরও হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীদের পরিবার। প্রতিকার পেতে জিডি ছাড়াও বাংলাদেশ-দুবাই দূতাবাসের মাধ্যমে ঢাকা জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন তাঁরা। পরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পুলিশ সুপারকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে খায়রুলের ভাই বাপ্পী সমকালকে বলেন, ‘ভাই দুবাই থাকেন, পরিবারকে টাকা পাঠাবেন এটিই স্বাভাবিক। একটি ঝামেলা হয়েছে, এসব মেটাতে কাগজপত্র পিবিআইকে দেওয়া হয়েছে।’ তিনি জানান, মেহরিমা নারী উন্নয়ন সংস্থা পরিচালনা করেন তাঁর মা বেবি আক্তার ও ভাবি। আলাপের এক পর্যায়ে বাপ্পী পাল্টা অভিযোগ করেন, নাজমুল, জামান ও আরিফ গং ভাইকে কানাডা পাঠানোর কথা বলে দুবাই নিয়ে মাস ছয়েক আটকে রাখেন। এ জন্য টাকা-পয়সা এমনকি পাসপোর্ট কেড়ে নেন। পরে তিনি দূতাবাসের সহায়তায় দেশে আসেন।

তবে মিম এয়ার ট্রাভেলসের মালিক মো. সুমন সমকালকে জানান, তাঁদের মাধ্যমে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই যান খায়রুল ইসলাম। দুবাইয়ে খায়রুলকে যেন আশ্রয় দেন তা জহুর আলী তাঁর পূর্বপরিচিত একজনকে অনুরোধ করেন। এর পর সেখানে কী ঘটেছে, তা জানা নেই।

জহুর আলী বলেন, ‘খায়রুল নামে কাউকে আমি চিনি না। তবে পরিচিত মিম এয়ার ট্রাভেলসের মালিক সুমনের অনুরোধে দুবাই প্রবাসী আমার বন্ধু নাজমুলকে ফোন করে এক ব্যক্তিকে কয়েক দিন আশ্রয় দিতে বলেছিলাম। এখন শুনছি, ওই ব্যক্তিই প্রতারক খায়রুল। কানাডায় পাঠানোর কোনো আলাপ আমাদের মধ্যে সে সময় হয়নি।’

খায়রুলের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়ার বিষয়ে মো. আব্দুল্লাহ বলেন, ‘জসিমের মাধ্যমে খায়রুলের সঙ্গে পরিচয়। একদিন তিনি দাদার মৃত্যুর খবর জানিয়ে পাসপোর্ট জমার শর্তে এক সপ্তাহের জন্য টাকা ধার চান। পাসপোর্ট রেখে তাঁকে ৫ হাজার দিরহাম (দেড় লাখ টাকা) দিই। কিছুদিন পরে শুনি খায়রুল পালিয়ে গেছেন।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘টাকা লেনদেন নিয়ে দুটি পক্ষের মধ্যে ঝামেলা চলছে। উভয় পক্ষ তাদের কাগজপত্র জমা দিয়েছে। মুখোমুখি করতে না পারলে সমাধান হচ্ছে না। দেশে আসতে বললেও নাজমুল আসছেন না।’