নিউইয়র্ক টাইমস চীনে স্বর্ণের চাহিদা দিয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে দেশটির তরুণী লিনের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, ২৫ বছর বয়সী এই নারী শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নিয়ে ছোট দানা আকারের স্বর্ণ কিনছেন। স্বর্ণের গয়না, বার বা কয়েন কেনার সামর্থ্য না থাকলেও স্বর্ণের দানা কিনে খুশি তিনি। স্বর্ণের প্রতি মানুষের আকর্ষণের দৌড়ে সামর্থ্য অনুযায়ী শামিল হয়েছেন তিনি।

নিউইয়র্ক টাইমসকে লিন বলেছেন, আমি আরও সঞ্চয় করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। লিন জানান, স্বর্ণের দানা কিনে ভালোই লাগছে তার; আপাতদৃষ্টে মনে হয়, এটা আর দশটা কেনাকাটার মতো। কিন্তু আদতে এটা এক ধরনের বিনিয়োগ। দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্বর্ণের দাম ওঠানামা করে, এটাই স্বাভাবিক। এখন যে দাম বাড়ছে, তা সীমার মধ্যে আছে বলেই তিনি মনে করেন।

২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও গত বছরের শেষ দিকে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বেড়েছে। এমনকি স্বর্ণের দাম আউন্সপ্রতি ২ হাজার ৪০০ ডলার ছিল বেশ কিছুদিন। বৈশ্বিক ও জাতীয় অনিশ্চয়তার মধ্যে স্বর্ণ হলো সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম। এবার মূলত চীনের মানুষের স্বর্ণ কেনার হিড়িক পড়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজারে এই ধাতুর দাম এভাবে বাড়ছে।

ঋণভারে জর্জরিত চীনের আর্থিক খাত, আবাসন খাতের অবস্থাও ভালো নয়। এই বাস্তবতায় চীনের মানুষরা স্বর্ণের দিকে ঝুঁকেছেন। চীনাদের এই স্বর্ণ কেনার হিড়িকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বর্ণের রিজার্ভ বৃদ্ধি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে মার্কিন বন্ড কেনা কমিয়ে দিয়েছে বেইজিং। পূর্বের কেনা বন্ডও তারা ছেড়ে দিচ্ছেন। আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো বিষয় হলো, চীনের ফাটকাবাজদের তৎপরতা। তারা বাজি ধরছেন, ‘স্বর্ণের দাম আরও বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে।’

বৈশ্বিক স্বর্ণের বাজারে বরাবরই চীনের বড় প্রভাব আছে। এবার যে স্বর্ণ কেনার প্রতি মানুষের আকর্ষণ তৈরি হয়েছে, তাতে চীনের প্রভাব আরও বেশি করে দেখা যাচ্ছে। স্বর্ণের দাম ২০২২ সালের শেষভাগ থেকে এখন পর্যন্ত ৫০ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, যে সময়ে স্বর্ণের এই মূল্যবৃদ্ধি হলো, সেই সময় ঠিক স্বর্ণের দর বাড়ার জন্য উপযুক্ত ছিল না। এই সময়ে ফেডারেল রিজার্ভের নীতি সুদহার বেড়েছে, মার্কিন ডলারের বিনিময়মূল্যও বেড়েছে। এই বাস্তবতায় বিনিয়োগকারীরা সাধারণত মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের বিনিয়োগের জন্য হন্যে হয়ে ছোটেন; কিন্তু এবার তার মধ্যেও স্বর্ণের দাম বেড়েছে।

গত মাসের শেষ দিকে ফেডারেল রিজার্ভ ইঙ্গিত দিয়েছে, নীতি সুদহার এখন কমছে না। সেই সঙ্গে চলতি বছর ডলারের বিপরীতে বিশ্বের ১৫০টি মুদ্রার দরপতন হয়েছে; তা সত্ত্বেও বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ছে।

স্বর্ণের দাম ২ হাজার ৪০০ ডলারে ওঠার পর আবার তা ২ হাজার ৩০০ ডলারে নেমে এসেছে। কিন্তু বাজারে এমন মনোভাব ছড়িয়ে পড়েছে যে, স্বর্ণের দাম এখন আর অর্থনৈতিক শর্তের ওপর নির্ভর করে না বরং, চীনের ভোক্তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে।

চায়না গোল্ড অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে চীনের বাজারে স্বর্ণ কেনা-বেচা বেড়েছে ৬ শতাংশ। সংবাদে বলা হয়েছে, বিষয়টি এমন নয় যে আগের বছর স্বর্ণের বাজারের প্রবৃদ্ধি কম ছিল। বরং মনে রাখা দরকার, আগের বছর চীনে স্বর্ণের বাজারের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ শতাংশ।

চীনের মধ্যবিত্তের বিনিয়োগের প্রধান মাধ্যম আবাসন খাতের অবস্থা শোচনীয়। আবাসন খাতে বড় বড় বিনিয়োগ মুখ থুবড়ে পড়েছে। শেয়ারের সূচকও নিম্নমুখী। এ বাস্তবতায় চীনে যেসব বিনিয়োগ আসছে, তার মধ্যে অনেক বিনিয়োগই হচ্ছে স্বর্ণভিত্তিক তহবিলে। এ ছাড়া দেশটির তরুণরা সামর্থ্য অনুসারে স্বর্ণের দানা কিনছেন।

চীনের অনলাইন বাজারে বিক্রেতারা স্বর্ণের দানা বিক্রিতে আগ্রাসী বিপণন চালাচ্ছেন। আলিবাবার ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম তাওবাওতে বিক্রেতারা লাইভ স্ট্রিম করে স্বর্ণ বিক্রি করছেন। ক্রেতারা বলছেন, মনে হতে পারে যে মানুষ কেবল অনলাইনে কেনাকাটা করছেন; কিন্তু বাস্তবে এগুলো বিনিয়োগ।

চীনের বাজারে স্বর্ণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বর্ণের রিজার্ভ বৃদ্ধি। গত মার্চ মাসেও স্বর্ণ কেনা হয়েছে। ফলে এ নিয়ে টানা ১৭ মাস স্বর্ণের রিজার্ভ বাড়িয়েছে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছর বিশ্বের যেকোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তুলনায় চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশি স্বর্ণ কিনেছে। গত ৫০ বছরে তারা আর কখনোই এত স্বর্ণ কেনেনি। তা সত্ত্বেও চীনের রিজার্ভে স্বর্ণের হার মাত্র ৪ দশমিক ৬, যেখানে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এই অনুপাত দ্বিগুণ।

বেইজিংভিত্তিক গবেষণা-প্রতিষ্ঠান বিওসি ইন্টারন্যাশনালের বৈশ্বিক প্রধান অর্থনীতিবিদ গুয়ান তাও নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, আগে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বাজার থেকে রেনমিনবির বিনিময়ে স্বর্ণ কিনত। কিন্তু এবার তারা বিদেশি মুদ্রার বিনিময়ে স্বর্ণ কিনছে। এর মধ্য দিয়ে তারা মার্কিন ডলারসহ অন্যান্য বিদেশি মুদ্রা ব্যয় করছে।

সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস