প্রতিকূলতা কী জিনিস তা ভালো করেই জানেন দুবাইভিত্তিক ভারতীয় ব্যবসায়ী পিবি আবদুল জব্বার । তার ছোটবেলাটা কেটেছে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে। তবুও তিনি সেই কঠিন পরিস্থিতি দৃঢ়তার সাথে পেরিয়ে এসে আজ একজন সফল ব্যবসায়ী। আজ জব্বার একজন মিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী। সামলাচ্ছেন বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য। ১৬টি দেশে ৩৫০০ জনেরও বেশি লোক তার অধীনে কাজ করেন। প্যাকেজিং কোম্পানি হটপ্যাক গ্লোবালের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর আব্দুল জব্বার, গালফ নিউজকে জানিয়েছেন তার জীবন সংগ্রামের কথা।

ছোট চাকরি, কঠিন জীবন

আবদুল জব্বার ভারতের কেরালা রাজ্যের ত্রিশুর জেলার চামাক্কালা নামে একটি ছোট গ্রামে বেড়ে ওঠেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে তার বাবা এক দুর্ঘটনায় মারা যান। তার মা তাকে এবং তার ভাইদের বড় করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন। সেই থেকেই আবদুল জব্বারের সামনে উপস্থিত কঠিন চ্যালেঞ্জ।

বিজ্ঞাপন

কিশোর বয়সে এসে জব্বার উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে আসা লোকদের কাছ থেকে বিদেশী পণ্য সংগ্রহের ছোট ব্যবসার কাজ শুরু করেন। তখন কে জানতো এই উপসাগরীয় অঞ্চলই একদিন তাকে সফল ব্যবসায়ী করে তুলবে। সেইসময়ে ছোটখাটো চাকরি করে তিনি যে অর্থ উপার্জন করতেন তা দিয়ে লেখাপড়ার খরচ এবং সংসার চালাতেন । সেইসময় থেকেই বিদেশে উড়ে যাওয়ার এবং একজন সফল ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন জব্বার। অবশেষে, তার বিদেশ ভ্রমণের স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল যখন ১৯৯০ সালে চাকরির জন্য দুবাই যাবার সুযোগ আসে। পরিবারের দায়িত্ব নিতে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে দুবাইতে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেন জব্বার। তিনি তার চাচার ভিসা দিয়ে আল রাস এলাকায় একটি ইন্ডেন্টিং কোম্পানিতে কাজ করতে দুবাই আসেন।
ইন্ডেন্টিং কোম্পানি

ইন্ডেন্ট হলো একটি নথি যা পণ্যের প্রয়োজনীয়তা এবং তার স্পেসিফিকেশন উল্লেখ করে । এটি স্টোর ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হয়, আইটেমগুলি সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট দিনে ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হয় । কোম্পানিটি বিভিন্ন শিল্প থেকে ট্রেডিং কোম্পানিকে নমুনা প্রদানের কাজ করে।

চ্যালেঞ্জ থেকে সুযোগ

আবদুল জব্বার দ্রুত কাজ শিখেছেন। প্রায় এক বছরের ব্যবধানে তিনি ব্যবসা পরিচালনার কাজ আয়ত্ত করেছিলেন। সেখান থেকে, তিনি কীভাবে একটি ম্যানুফ্যাকচারিং অপারেশন চালাতে এবং পরিচালনা করতে হয় সেদিকে মনোনিবেশ করেন। ধীরে ধীরে নিজের ব্যবসা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন এই পরিশ্রমী যুবক। শেখার প্রতি তার ভালবাসা তাকে একজন অলরাউন্ডারে পরিণত করেছে, ব্যবসার সমস্ত দিক- বিক্রয়, অ্যাকাউন্টিং বা পরিচালনার দিকটি তার নখদর্পনে। জব্বারের মতে , ”এই সবই আমাকে জ্ঞান এবং আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। আমাকে স্বাধীন হতে এবং চ্যালেঞ্জগুলিকে সুযোগে রূপান্তর করতে শিখিয়েছে।”

প্রাথমিক উদ্যোগ

১৯৯৫ সালে মাজেদ প্লাস্টিক নামে প্যাকেজিং শিল্পের মাধ্যমে নিজস্ব উদ্যোগ শুরু করেন আবদুল জব্বার। গোল্ড স্কোয়ারের কাছে ডেইরাতে একটি গুদাম এবং অফিসঘর নিয়ে নিজ উদ্যোগ শুরু করেন তিনি। দুই বছরের মধ্যে আবুধাবিতে কোম্পানির প্রথম শাখা খোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি। বাড়তে থাকে ক্লায়েন্টর সংখ্যা। জব্বার আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, শীঘ্রই তিনি একটি উৎপাদন ইউনিট চালু করতে পারবেন। ২০০০সালে, তিনি হটপ্যাক প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ স্থাপন করেন এবং ২০০৫ সালে, কোম্পানিটি তার প্রথম উৎপাদন ইউনিটের সাথে আরও প্রসারিত হয়। আজ, হটপ্যাক মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, মরক্কো, ভারত, আইভরি কোস্ট, নাইজেরিয়া, স্পেন, মালয়েশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া জুড়ে ১৬ টি দেশে উপস্থিত রয়েছে। হটপ্যাক মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা (মেনা) অঞ্চলে উৎপাদন এবং সেলসের নেটওয়ার্কের একটি চেইনও চালায়। কোম্পানির ১৫টি উৎপাদন কেন্দ্র , ২৯টি শাখা, ৪৯টি বিক্রয় কেন্দ্র,৩৫০০ জনেরও বেশি কর্মচারীসহ, ৩১টি দেশে ক্লায়েন্ট হিসাবে ২৫,০০০ বেশি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড রয়েছে।

উদ্ভাবন: শেখার মূল চাবিকাঠি

শুরু থেকে, উদ্ভাবনের ওপর জোর দিয়েছে হটপ্যাক। আবদুল জব্বারের নেতৃত্বে, কোম্পানিটি ৩৫০০টিরও বেশি পণ্য তৈরি করেছে-ডিসপোজেবল পেপার কাপ থেকে ক্লিং ফিল্ম পর্যন্ত, গ্রাহকদের খাদ্য প্যাকেজিং সমস্যার সমাধান নিয়ে হাজির হয়েছে হটপ্যাক । আজ, হটপ্যাক হল GCC-তে ডিসপোজেবল ফুড প্যাকেজিং পণ্যগুলির বৃহত্তম প্রস্তুতকারক। আব্দুল জব্বারের কাছে নিত্যনতুন জিনিস শেখাই ব্যবসা বৃদ্ধির চাবিকাঠি। জব্বার একজায়গায় বলেছেন , ”আমি সবসময় বাজারে নতুন পণ্য সম্পর্কে শিখছি এবং কিভাবে আমরা আমাদের পণ্যগুলিকে আপ টু ডেট রাখতে পারি সে সম্পর্কে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছি। যখন আমি একটি নতুন প্ল্যান্ট পরিদর্শন করি, তখন আমি নতুন উদ্ভাবনী ধারণাগুলির দিকে নজর রাখি যাতে আমরা সেটিকে আমাদের ব্যবসায়িক ক্রিয়াকলাপে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি।”

জীবনব্যাপী শিক্ষা

জব্বারের মধ্যে শিক্ষার গভীর কৌতূহল রয়েছে। উদীয়মান প্রযুক্তি সম্পর্কে অন্বেষণ করে বেড়ান তিনি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের চেষ্টা করেন । তার আগ্রহগুলি প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, স্থায়িত্ব এবং পরিবেশগতভাবে সচেতন অনুশীলনের উপর ফোকাস করে। তিনি প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সেইসঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্বের কথাও মাথায় রাখেন। এতো সাফল্যের শিখরে পৌঁছেও আবদুল জব্বার তার শেকড় ভোলেননি। তিনি বাসাতে ফিরে লোকদের সাথে তার সাফল্য ভাগ করে নিতে পছন্দ করেন এবং তিনি যে সুযোগগুলি পেয়েছেন সেই একই সুযোগ দিতে চান তাদের ।

জব্বার জানাচ্ছেন – “আমি ত্রিশুরে এনভাইরোগ্রিন ক্যারি ব্যাগ (ইন্ডিয়া) প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি নতুন কোম্পানি শুরু করেছি, যা পরিবেশ বান্ধব কাগজের পণ্য তৈরি করে। সেখানে বসবাসকারী লোকদের জন্য অনেক নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করবে এটি । আমি স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার প্রচারে গভীরভাবে জড়িত। কোঝিকোড়/ত্রিশুরের দয়া হাসপাতালের পরিচালক এবং মাথিলাকামের ইউনিভার্সাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পরিচালক হিসেবেও ভূমিকা পালন করছেন জব্বার ।”

প্রাপ্তি

আবদুল জব্বারের কীর্তি অনন্য । ২০১৬ সালে, তিনি কাইরালি টিভি থেকে এনআরআই উদ্যোক্তা পুরস্কার জিতেছিলেন এবং ২০১৪ সালে, গ্লোবাল মিডিয়া ইভেন্টস এবং অ্যাচিভমেন্টস অ্যাওয়ার্ড যেতেন । জব্বার ইউনিভার্সাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ- ত্রিশুর এবং কেরালার দয়া হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। এছাড়াও তিনি SAFI ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজ, কালিকট, কেরালা এবং বেশ কয়েকটি শিক্ষা ও দাতব্য সংস্থার একজন ট্রাস্টি।

পুরস্কার

২০১৪ তে কাইরালি টিভি থেকে এনআরআই উদ্যোক্তা পুরস্কার
গ্লোবাল মিডিয়া ইভেন্টস এবং অ্যাচিভমেন্টস অ্যাওয়ার্ড ২০১৬
সিইও ফর লাইফ ২০২১
২০২১সালের প্যাকেজিং পার্সোনালিটি (প্রাইম অ্যাওয়ার্ডস)
সিইও মিডল ইস্ট ২০২২ (আইটিপি মিডিয়া)

নিজের সাফল্যের কৃতিত্ব মাকে দিতে চান এই কোটিপতি। জব্বার বলছেন, “আমি আমার মায়ের কাছে কৃতজ্ঞ যার আশীর্বাদ ছাড়া আমি এতদূর আসতে পারতাম না। তিনি আমাকে আমার সমস্ত কর্তব্যে নম্র হতে শিখিয়েছেন। কোনো নতুন উদ্যোগ শুরু করার আগে আমি সবসময় তার আশীর্বাদ চাই।” হটপ্যাক-এ তার ভাইদের পাশে পেয়ে তিনিও উচ্ছসিত । জয়নুদিন এবং আনোয়ার যথাক্রমে হটপ্যাকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। স্ত্রী সাদিয়া এবং চার সন্তানকে নিয়ে নতুন উচ্চতায় পৌঁছানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন একদা কেরালার ছোট গ্রামের সেই ছোট্ট ছেলেটি।

সূত্র : গালফ নিউজ