ঢাকার আকাশে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি। বৈরী আবহাওয়ায় বিমানবন্দরে অবতরণ করতে না পেরে মেঘলা আকাশে চক্কর দিচ্ছিল কয়েকটি প্লেন। এয়ার ট্রাফিকে যুক্ত হয় থাইলেন্ডের ব্যাংকক থেকে ছেড়ে আসা ইউএস-বাংলার একটি ফ্লাইট। প্রায় ২০ মিনিট ঘোরার পর রানওয়েতে অবতারণের অনুমতি পায় ফ্লাইটটি।

কিন্তু পাইলট ফ্লাইটটি অবতরণ করতে গেলে ঘটে বিপত্তি। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়ির ছাদ থেকে পাইলটের চোখে লেজার লাইট নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে ফ্লাইট অবতরণ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও দক্ষতার সঙ্গে ফ্লাইটটি অবতরণে সক্ষম হন পাইলট।

গত ১৯ মার্চ রাত সাড়ে সাতটায় এমন ঘটনার সাক্ষী হন ফ্লাইটটিতে থাকা যাত্রীরা। রাত ৮টা ৫০ মিনিটে ফ্লাইটটি অবতরণে সিদ্ধান্ত নেন পাইলট। এসময় ফ্লাইটটি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ওপর দিয়ে অবতরণে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখন সিদ্ধিরগঞ্জ, ঢাকার ডেমরা, রামপুরা, আফতাব নগর, বাড্ডা, কুড়িল এলাকা থেকে ফ্লাইটের দিকে প্রচুর সংখ্যক লেজার লাইট নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতি দেখে আঁতকে ওঠেন যাত্রীরা। পরে দক্ষতার সঙ্গে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণ দিক থেকে রানওয়েতে নিরাপদে অবতরণ করে ফ্লাইটটি।

এই ফ্লাইট পরিচালনায় যুক্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি উড়োজাহাজ উড্ডয়নের পর থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত পাইলটকে পেরোতে হয় বেশ কয়েকটি ধাপ। প্রতিটি সেকেন্ডই তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এসময় এক মুহূর্তের জন্য মনোযোগ হারালেই ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। অথচ ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাতে উড্ডয়ন অথবা অবতরণের সময় পাইলটদের চোখে নিয়মিত নিক্ষেপ করা হচ্ছে লেজার লাইট। এতে তাদের সাময়িক দৃষ্টিবিভ্রম হয়।

যখন কোনো উড়োজাহাজের পাইলট ল্যান্ডিং পজিশনে থাকেন এমন সময় যদি কেউ তার চোখে লেজার লাইট মারে তখন পাইলটের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এটা প্লেন চালানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি ব্যাপার। সিভিল অ্যাভিয়েশনের পক্ষ থেকে এজন্য আইন করা হয়েছে। এছাড়া নিয়মিয়ভাবে টিভি স্ক্রল ও মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে সচেতনতার জন্য সিভিল অ্যাভিয়েশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়।- শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম

বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেশ-বিদেশের এয়ারলাইন্সগুলো বারবার শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। কিন্তু বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তা বন্ধে তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। এ বিষয়ে আইন থাকলেও তার প্রয়োগ করা হয় না। অথচ লেজার লাইট নিক্ষেপের কারণে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বিষয়টি নিয়ে লেখালেখিও কম হয়নি। মন্ত্রী-এমপিদের এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখতে দেখা গেছে। অথচ নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ।

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা ফ্লাইটে লেজার লাইট নিক্ষেপের বিষয়টি অবগত আছেন। এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধে তারা বিভিন্ন সময় জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করছেন। পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থা নিতে পুলিশের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বলা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ করাটা খুবই কঠিন। কারণ, কখন কোন ভবন বা বাসার ছাদ থেকে লেজার লাইট নিক্ষেপ করা হয়, তার সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ বা নির্ধারণ করা কঠিন। তাই জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘যখন কোনো উড়োজাহাজের পাইলট ল্যান্ডিং পজিশনে থাকেন এমন সময় যদি কেউ তার চোখে লেজার লাইট মারে তখন পাইলটের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এটা প্লেন চালানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি ব্যাপার। সিভিল অ্যাভিয়েশনের পক্ষ থেকে এজন্য আইন করা হয়েছে। এছাড়া নিয়মিয়ভাবে টিভি স্ক্রল ও মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে সচেতনতার জন্য সিভিল অ্যাভিয়েশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়।’

তিনি বলেন, ‘সিভিল অ্যাভিয়েশনের পক্ষ থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেও জানানো হয়েছিল, যাতে এটি বন্ধ করা হয়। লেজার লাইট নিক্ষেপ বন্ধে সর্বসাধারণের সচেতনতা একটি বিষয়। খেলার ছলে কিংবা ছোট বাচ্চারা যাতে এটি না করে আমি জাগো নিউজের মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করতে চাই।’

এখন ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দিনে দেশ-বিদেশের তিন শতাধিক বাণিজ্যিক ফ্লাইট অবতরণ এবং উড্ডয়ন করে। এর মধ্যে রাজধানীর বাউনিয়া, উত্তরা, বিমানবন্দর রোড, নিকুঞ্জ, কুড়িল, সাভার ও আশুলিয়া থেকে বেশি লেজার লাইট নিক্ষেপ করা হয়।

তবে ২০১৯ সালের জুনে ফ্লাইটে লেজার লাইট নিক্ষেপ নিয়ে একটি কড়া নির্দেশনা দেয় শাহজালাল বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, দেশের বিমানবন্দরগুলোতে উড়োজাহাজ ওঠা-নামার সময় টার্গেট করে লেজার বিম প্রদর্শনের ঘটনা ঘটছে। এটি সিভিল অ্যাভিয়েশন অ্যাক্ট-২০১৭ অনুযায়ী একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পাইলটের দিকে এভাবে লেজার প্রদর্শন উড়োজাহাজ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা করে, যা ফ্লাইটকে অনিরাপদ করে। তাই একটি ফ্লাইট যাতে নিরাপদে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারে সেজন্য সবাইকে লেজার বিম ছোড়া থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে।

এ ছাড়া আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি প্লেন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে মানুষের জীবন ঝুঁকিতে ফেললে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অনধিক পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশে উচ্চক্ষমতার লেজার রশ্মি ব্যবহারে শাস্তির বিধান রয়েছে বলে জানিয়েছে বেবিচক সূত্র।

এখনো পাইলটরা লেজার লাইট নিক্ষেপের বিষয়ে অভিযোগ দিচ্ছেন। মূলত যে লেজার লাইট মারছে তৎক্ষণাৎ পুলিশ পাঠিয়েও ধরা যায় না, তারা পালিয়ে যায়। এটি বন্ধ করতে নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাতার এয়ারওয়েজের এক পাইলট জাগো নিউজকে বলেন, ‘লেজার লাইটের আলোয় মুহূর্তেই একটি প্লেন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যারা মজারছলে এ কাজ করছে, তারা হয়তো বুঝতেই পারছে না। এটি একজন পাইলটের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক।’

‘প্রতিটি বিমানবন্দরে অবতরণের সময় সেকেন্ডে সেকেন্ডে চার্ট ফলো করতে হয়। কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ রাখতে হয়। ওই সময় লেজার নিক্ষেপ করলে মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে। আবার চার্ট ও ইনস্ট্রুমেন্ট দেখতে সমস্যা হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগ পাইলট রাতে বাংলাদেশে ল্যান্ড করতে এলে এই সমস্যায় পড়েন।’

থামছে না পাইলটের চোখে লেজার নিক্ষেপ, ঝুঁকি নিয়েই ফ্লাইট অবতরণ

লেজার লাইটের রশ্মিতে অন্যতম ভুক্তভোগী ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিদিন সন্ধ্যার পর শাহজালালে ল্যান্ডিংয়ের সময় নিয়মিত লেজার লাইট নিক্ষেপের সম্মুখীন হতে হয়। এটা উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার জন্য কতবড় ঝুঁকি তা বলে বোঝানো যাবে না।’

‘যারা লেজার লাইট নিক্ষেপ করছে তারা হয়তো না বুঝেই করছে। তাদের সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি সিভিল অ্যাভিয়েশন, সাংবাদিকসহ এলাকার জনপ্রতিনিধি বা ওয়ার্ড কমিশনাররা লেজার লাইটের ভয়াবহতা সম্পর্কে শিশু-কিশোর ও তরুণদের সচেতন করতে পারেন। এরপর তাদের ট্র্যাক করে আইনের আওতায় আনতে হবে।’

তবে যারা লেজার লাইট নিক্ষেপ করে তাদের আইনের আওতায় আনা কঠিন বলে জানান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এখনো পাইলটরা লেজার লাইট নিক্ষেপের বিষয়ে অভিযোগ দিচ্ছেন। মূলত যে লেজার লাইট মারছে তৎক্ষণাৎ পুলিশ পাঠিয়েও ধরা যায় না, তারা পালিয়ে যায়। এটি বন্ধ করতে নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব নয়।’

Jagonews24 Google News Channelজাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন আমাদের গুগল নিউজ চ্যানেল।
প্লেনে লেজার লাইট নিক্ষেপে পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শাজাহান জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত তিন মাস আগে আমি পুলিশের উত্তরা বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছি। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কেউ আমার কাছে অভিযোগ করেনি। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বা অন্য কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’