সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এখন বিশ্বের বড় বড় ধনীদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। ফলে দেশটির এখন শনৈঃ শনৈঃ অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে। সেই সঙ্গে এর ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হচ্ছে। ৩০ নভেম্বর দেশটিতে বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ১২ দিনের এই সম্মেলনে সারা বিশ্ব থেকে ৭০ হাজার প্রতিনিধি যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।দ্য ইকোনমিস্ট–এর এক সংবাদে বলা হয়েছে, দুবাই শহরের শান শওকত দেখে এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের চোখ ধাঁধিয়ে যাবে।

গোল্ডেন ভিসা দিয়ে বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), বিশেষ করে দুবাই শহর। বদৌলতে শহরটির আবাসন বাজার বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়ে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে ইউএই। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক: পাম জেবেল আলি নামের এক কৃত্রিম দ্বীপ প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের এক সকালে এটির কার্যালয়ের সামনে ক্রেতারা ব্যাপক ভিড় করেন।

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতো সংযুক্ত আরব আমিরাতও জ্বালানি তেলের অন্যতম কেন্দ্র। গত বছর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার আয় করেছে দেশটি। তবে তারা এখন আর নিছক জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল না থেকে বরং অর্থনীতির বহুমুখীকরণে জোর দিয়েছে। জ্বালানি তেল থেকে এখন তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র এক-তৃতীয়াংশ আসে। গত বছর দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৪১ শতাংশ।

অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি যে উজ্জ্বল হচ্ছে, তার বড় নিদর্শন হলো বৈশ্বিক জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন বা কপ আয়োজন। দেশটির উন্মুক্ত অর্থনৈতিক নীতি ও রাজনীতি নিরপেক্ষ ব্যবসায়িক মনোভাবের কারণে সব জাতি ও বর্ণের ব্যবসায়ীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে দুবাই, বিশ্বের খুব কম স্থানেই এটা হয়। এ ছাড়া বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকেই সাড়ে আট ঘণ্টায় দুবাই আসা-যাওয়া করা যায়। ফলে দীর্ঘ বিমান ভ্রমণ এড়িয়ে কম সময়ে ব্যবসায়িক আলোচনা-সমঝোতা সারার জন্য এই শহরকে বেছে নেন অনেকেই।

তবে অর্থনৈতিক পরিবর্তন ও সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে নতুন চ্যালেঞ্জও সামনে আসছে ইউএইর। অর্থনীতিতে নতুন খাত সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে দেশটির সামাজিক চুক্তিও বদলে যাচ্ছে। নতুন নতুন কর আরোপিত হচ্ছে।

সেই সঙ্গে মানুষেরও নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সময় এসেছে বলে মনে করা হয়। তবে সংযুক্ত আরব আমিরাত চূড়ান্ত বিচারে রাজতান্ত্রিক হওয়ায় মানুষের দ্বিমত পোষণ করার পরিসর কম। শাসকের কর্তৃত্বের ওপর লাগাম না থাকায় নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা ও ভুল নীতি গ্রহণের অনেক অবকাশ রয়েছে।

আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ইতিহাস আছে। একসময় তারা ছিল মুক্তাসংগ্রাহক জাতি, সেখান থেকে তারা পরবর্তীকালে পেট্রো মানে তেলের রাষ্ট্র হয়ে ওঠে। সে জন্য এখন পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে তারা বেশ মুনশিয়ানার পরিচয় দিচ্ছে বলে মনে করে দ্য ইকোনমিস্ট।

ভৌগোলিকভাবে আরব আমিরাত তিনটি মহাদেশের নিকটবর্তী—আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়া। সে দেশেই অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম কনটেইনার বন্দর জেবেল আলি। দুবাই বিমানবন্দরও বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ফলে লজিস্টিক তথা পণ্য পরিবহন সেবা সে দেশের জিডিপিতে প্রায় ৮ শতাংশ অর্থের জোগান দিচ্ছে।

ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক থেকে যথেষ্ট সুবিধাজনক স্থান হওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দুবাইয়ে নতুন ব্যবসার হিড়িক পড়েছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দুবাই চেম্বার অব কমার্সের সদস্য হওয়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪০ শতাংশ বেড়েছে।

চীনের কোম্পানিগুলো যেখানে আরব আমিরাতকে অফশোর বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করে, সেখানে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুবাইকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুবিধাজনক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করে। আরব আমিরাতের দক্ষ আদালত ব্যবস্থা, অবকাঠামো, পুঁজি ও মেধার কারণে ভারতীয় কোম্পানিগুলো সেখানে যেতে আগ্রহী হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় কথা, পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা সংযুক্ত আরব আমিরাতে যেন কাজ করে না। সে জন্য বিভিন্ন দেশের যেসব কোম্পানি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে, তারা দুবাইকে ব্যবসায়ের নিরাপদ কেন্দ্র হিসেবেই বিবেচনা করে। দেখা যায়, ইরানের তেল প্রায়ই আমিরাতের সাগরে ট্যাংকার পরিবর্তন করে; সেখানে অন্যান্য জাতের অপরিশোধিত তেলের সঙ্গে ইরানের তেলের সংমিশ্রণ হয় এবং বেচাকেনা হয়।

নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার ধনকুবেররা এখন ইউরোপ বা আমেরিকায় যেতে পারেন না। সে জন্য ব্যবসা করার নিরাপদ জায়গা হিসেবে তাঁরা দুবাইকে বেছে নিয়েছেন। মহামারির সময় হংকংয়ের লকডাউন যেন শেষ হচ্ছিল না, ফলে হংকংভিত্তিক অনেক ব্যবসায়ী দুবাই পাড়ি দেন। সব মিলিয়ে গত কয়েক বছরে বিশ্বের যেকোনো জায়গার চেয়ে ধনীরা দুবাইয়ে বেশি পাড়ি জমিয়েছেন।

মুসলিম দেশ হলেও আরব আমিরাত আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য সহজতর করতে সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র ও শনিবার থেকে পরিবর্তন করে শনি ও রোববার করেছে।

দেখা যাচ্ছে, কোভিড-১৯–এর জের ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবসহ বিভিন্ন কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যখন টানা প্রায় চার বছর ধরে একধরনের স্থবিরতা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে, তখনো দুবাইয়ের উত্থান অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। এমনি এমনি তা হচ্ছে না, যথাযথ নীতি প্রণয়ন করেই তারা এই গতি এনেছে।

কিন্তু ভবিষ্যৎ অতটা মসৃণ না–ও হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা আবার যেভাবে বাড়ছে, তাতে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। সেই সঙ্গে নতুন অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানোর চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে তাদের।

সুত্রঃ প্রথম আলো