সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১১ শতাংশ স্থানীয়। বাকি ৮৯ শতাংশই বিভিন্ন দেশ থেকে যাওয়া প্রবাসী। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। যদিও দেশটি থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের দিক থেকে বাংলাদেশী শ্রমিকদের অবস্থান ষষ্ঠ। সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠান ভারতীয়রা। দ্বিতীয় স্থানটি পাকিস্তানিদের। সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পাঠানোর দিক থেকে তৃতীয় ফিলিপাইন, চতুর্থ ইরান ও ও পঞ্চম স্থানে মিসর।

অভিযোগ রয়েছে, আরব আমিরাতে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশই আসছে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে। মধ্যপ্রাচ্যের সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশটি এখন বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারেরও অন্যতম প্রধান গন্তব্য হয়ে উঠছে।

আরব আমিরাত সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ইউএইতে বসবাসরত ৯০ লাখ বিদেশীর মধ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যা সাড়ে ৭ লাখ। দেশটিতে বসবাসরত ১ কোটির কিছু বেশি সংখ্যক লোকের মধ্যে ৭ দশমিক ৪ শতাংশই বাংলাদেশী। কয়েক বছরে এ দেশ থেকে আমিরাতগামীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। শুধু গত দেড় বছরেই প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশী অভিবাসী হয়েছেন আমিরাতে। তবে সে অনুপাতে বাড়েনি রেমিট্যান্স প্রবাহ।

সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইউএইর (সিবিইউএই) ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে আরব আমিরাত থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রেমিট্যান্স হিসেবে গেছে ১৪৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন দিরহাম (সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ৩৯ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ)। এর অর্ধেকেরও বেশি গেছে ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনে। কেবল ভারতেই গেছে প্রায় সাড়ে ৩০ শতাংশ, যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৪ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন দিরহামের মতো। সর্বশেষ বিনিময় হারের ভিত্তিতে হিসাব করলে দেখা যায়, ইউএই থেকে ২৮ লাখ ভারতীয় গত বছর ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স নিজ দেশে পাঠিয়েছেন।

একই সময়ে আরব আমিরাত থেকে বের হওয়া রেমিট্যান্সের ১২ দশমিক ২ শতাংশ গেছে পাকিস্তানে, যার পরিমাণ প্রায় ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন দিরহাম। ডলারে রূপান্তর করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪৮৪ কোটি বা ৪ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে বসবাসরত পাকিস্তানির সংখ্যা ১২ লাখ ৯০ হাজার। একই সময়ে ইউএইর বহির্মুখী রেমিট্যান্সের ৮ দশমিক ৪ শতাংশ গেছে ফিলিপাইনে। সে অনুযায়ী দেশটিতে গত বছর ইউএই থেকে রেমিট্যান্স গেছে প্রায় ১২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন দিরহাম। ডলারে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩৩৩ কোটি বা ৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন। ইউএইতে ফিলিপাইনের নাগরিক রয়েছেন ৫ লাখ ৭০ হাজার।

ইউএইতে ৪ লাখ ৮০ হাজার অভিবাসী আছে ইরানের। আর মিসরের অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যাও ৪ লাখ ৩০ হাজারের মতো। কিন্তু এ দুটি দেশের অভিবাসীরা নিজ দেশে বাংলাদেশীদের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠান। মিসরের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে আরব আমিরাত প্রবাসী মিসরীয়রা ৩৪০ কোটি বা ৩ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার নিজ দেশে পাঠিয়েছেন। ইরানও প্রায় কাছাকাছি রেমিট্যান্স আহরণ করছে ইউএই থেকে। অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটি থেকে মাত্র ২০৭ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কিছুটা বাড়লেও সেটি ৩০৩ কোটি ডলারেই সীমাবদ্ধ ছিল।

নিজেদের ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে সম্প্রতি আরব আমিরাত সফরে যান সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাফর আলম। দেশটির চারটি শহরে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশীদের সমাবেশে বক্তব্য দেন। জানতে চাইলে জাফর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌প্রবাসী বাংলাদেশীদের আমরা বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানোর উপকারিতা সম্পর্কে বুঝিয়েছি। বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে তারা নিজেদের কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। আমরা সেগুলো সমাধানে করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়েছি। পাশাপাশি নতুন কিছু মানি এক্সচেঞ্জের সঙ্গে চুক্তি করেছি। এসব তৎপরতার ফলে আরব আমিরাত থেকে আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।’

সংযুক্ত আরব আমিরাতের বৃহত্তম শহরগুলোর একটি শারজাহ। ওই শহরে স্বল্প পুঁজির একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালান বাংলাদেশী ইসমাঈল হোসেন। বণিক বার্তাকে এ প্রবাসী বলেন, ‘‌আমার গ্রাহকদের বড় অংশ বাংলাদেশী শ্রমিক। এ কারণে শারজাহ শহরে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। তাদের বেশির ভাগই হুন্ডির মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স পাঠান। এখানে কিছু বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন দেশের হুন্ডি কারবারিরা প্রবাসীদের বাসা ও কর্মস্থলে গিয়ে অর্থ নিয়ে আসে। পরে সে অর্থ তারা নিজ দায়িত্বে বাংলাদেশে থাকা স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয়। তাছাড়া মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে দেশের ব্যাংকে রেমিট্যান্স পাঠাতে হলে ফি বেশি লাগে। আবার ডলারের দরও কম পাওয়া যায়। এ কারণে প্রবাসী বাংলাদেশীরা হুন্ডিতেই বেশি স্বাছন্দ্য বোধ করেন।’

আরব আমিরাতে বিশেষ করে দেশটির দুবাইয়ের বিভিন্ন খাতে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশীদের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের তথ্য উঠে এসেছে। দেশের অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই এখন দুবাইকে বেছে নিয়েছে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের কেন্দ্র হিসেবে। ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ থেকে অনেক ব্যবসায়ী ওই শহরে অনানুষ্ঠানিক অফিস খুলে সেখান থেকে ব্যবসা পরিচালনা করছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

দুবাই তথা আরব আমিরাত থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রেমিট্যান্স না আসার পেছনে এটিকে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, হুন্ডি-হাওলার এজেন্টরা সেখানে বাড়তি সুবিধা দিয়ে প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে রেমিট্যান্সের অর্থ সংগ্রহ করছে। আর দেশে তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশী টাকায় সমপরিমাণ অর্থ পৌঁছে দিচ্ছে প্রবাসীদের পরিবারের কাছে।

অন্যদিকে হুন্ডি-হাওলার এজেন্টরাই এখন দুবাইয়ে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দুবাইভিত্তিক এক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, বাংলাদেশী ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীরা এখন বিনিয়োগ ও সম্পদ স্থানান্তরের জন্য দুবাইকে বেছে নিচ্ছেন।

এক্ষেত্রে আমিরাতে বসবাসকারী বাংলাদেশী একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও অন্য ব্যবসায়ীরা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখছেন। বড় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীরাও এখন দুবাইয়ে আউটলেট খুলছেন। ঢাকার বসুন্ধরা সিটিতে দোকান আছে এমন ব্র্যান্ডগুলোরও দুবাইয়ের বিভিন্ন শপিং মলে শোরুম আছে। এ ধরনের বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্সের অর্থকে কেন্দ্র করে দুবাইভিত্তিক হুন্ডি-হাওলার ব্যবসা এখন রমরমা।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, আরব আমিরাতে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। ২০২১ সালে সংস্থাটির সনদ নিয়ে ২৯ হাজারের বেশি বাংলাদেশী শ্রমিক আমিরাত প্রবাসী হয়েছেন। ২০২২ সালে গেছেন ১ লাখ ১ হাজার ৭৭৫ জন।

আর চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গেছেন ৪২ হাজারেরও বেশি। আবার উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী শিক্ষার্থীও এখন আরব আমিরাত যাচ্ছেন। তাদের অনেকে পড়ালেখা শেষ করে দেশটির কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক লোক এ দেশ থেকে আমিরাত গেলেও রেমিট্যান্স প্রবাহে তার প্রভাব দৃশ্যমান হচ্ছে না। উল্টো ২০২১-২২ পর্যন্ত টানা তিন অর্থবছর ধরে বাংলাদেশে ইউএই থেকে রেমিট্যান্স কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরেও দেশটি থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৪৭ কোটি ডলারের বেশি। পরের বছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় প্রায় ২৪৪ কোটিতে। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা আরো কমে ২০৭ কোটি ডলারে নেমে আসে। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষের দিকে ইউএই থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহে কিছুটা উন্নতি ঘটেছে।

এ কারণে অর্থবছর শেষে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০৩ কোটি ডলার।

সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ ও অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধ করতে কয়েক বছর আগে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইউএইর সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সংস্থাটির প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বিশ্বের অনেক দেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের সঙ্গে বিএফআইইউর তথ্য বিনিময়সংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে।

এ চুক্তির আওতায় আমরা আর্থিক অপরাধসংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান করছি। আরব আমিরাতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিভিন্ন সময়ে তথ্য চেয়েছি। তারাও আমাদের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠায়। বিএফআইইউ হুন্ডি তৎপরতা বন্ধে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।’